Wednesday, January 20, 2010

BANDARER ITIKATHA

বাঁদরনাচের ইতিকথা

নিজস্ব প্রতিনিধি: কমরেড জ্যোতি বসুর জীবনাবসানে ব্যথিত হৃদয়ে মানুষ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাঁর মতো এক চলমান ইতিহাসকে হারিয়ে যে কোনো সুস্থ মানুষ ও সমাজ শোকাহত হবে, এ স্বাভাবিক। তবে, সবাই সুস্থ নন, অসুস্থরা অনেকে সংবাদমাধ্যমের মালিক বা কেউকেটাও। গত কয়েকদিন এই অসুস্থদের অতি গভীর ও রক্তে মিশে যাওয়া অসুখ প্রকাশ্য চলে এসেছে।
স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্টদের বেআইনী করার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, উচিত সিদ্ধান্ত, সরকারের আরো আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিলো। কমিউনিস্ট-বিদ্বেষের এই উত্তরাধিকার আনন্দবাজারের মালিকদের পরবর্তী প্রজন্মগুলিও পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতোই পেয়েছে এবং বহন করে নিয়ে গেছে। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ একদিনের জন্যও থামায়নি তারা। কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিশেষ করে জ্যোতি বসু তাদের প্রতিদিনের আক্রমণের শিকার ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পুরো সময়কাল জুড়ে। দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর পরেও তিনি সমানভাবেই আনন্দবাজারের কুৎসিত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু রয়ে গেছেন।
সংবাদমাধ্যমের অধিকার আছে যে কোনো ব্যক্তিত্বের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ণ করার। অধিকার থাকলেও অবশ্য আনন্দবাজারের সে ইচ্ছা বা ক্ষমতা নেই। কিন্তু মূল্যায়ণের বদলে সদ্যপ্রয়াত এক শ্রদ্ধেয় মানুষ সম্পর্কে যে কোনো ভাষায় যা খুশি মন্তব্য করার জন্য পাতার পর পাতা খরচের বহর দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এও এক রাজনৈতিক প্রকল্প। তবে, শৈশব থেকে সহবৎ শিক্ষার অভাব এই মদগর্বীদের ক্ষেত্রে অতি উৎকট।
কমরেড জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের পরের দিন আনন্দবাজার ‘মূল্যায়ণ’ করানোর দুর্ধর্ষ টিম তৈরি করেছিল। বামপন্থী কর্মীদের রক্তে হাত রাঙানো সিদ্ধার্থশঙ্কর, তাঁর যোগ্যতম শিষ্যা মমতা ব্যানার্জি, হিন্দুত্ববাদী গৈরিক সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত, মিডিয়ায় সর্বঘটে কাঁঠালি কলা ‘অর্থনীতিবিদ’ অভিরূপ সরকার। নামেই মালুম তাঁরা কী লিখতে পারেন, লিখেছেনও। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামপন্থীরা কীভাবে বাংলার ‘সর্বনাশ’ করেছে, তা লিখেছেন তাঁরা। সংবাদ থেকে সম্পাদকীয়তে মনের যত বিষ উগরে দিয়েছে সরকার পরিবার ও তাদের অর্থপুষ্টরা।
কিন্তু যেমন চিরকাল হয়ে এসেছে, আবারও তা—ই হয়েছে। কোনো কুৎসাই ঠেকাতে পারেনি বাঁধভাঙা মানুষকে। কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রবল শীতের ভোর থেকে অস্তসূর্যের রশ্মি বিলীন হওয়া পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ মহানগরের রাজপথ ভাসিয়ে দিয়েছেন। আর, এতেই আরো ক্ষিপ্ত আনন্দবাজার ডুমুরপাতার আচ্ছাদনটুকু পর্যন্ত খসিয়ে উলঙ্গ হয়ে নেমে বুধবারের সংবাদের পাতা এবং সর্বোপরি সম্পাদকীয়তে সভ্যতা-ভব্যতার ন্যূনতম সীমাটি লঙ্ঘন করেছে।
কলকাতার মেয়র একটি রাস্তার নাম প্রয়াত জননেতার নামে রাখার প্রস্তাব করায় ‘স্মৃতির উদ্দেশে’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে আনন্দবাজার লিখেছে: ‘ জ্যোতি বসু কেবল জননেতাই ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাও। তাঁহার সেই ভূমিকার স্মরণে দলের তরফে তাঁহার নামাঙ্কিত পুরস্কারও ঘোষণা করা যাইতে পারে— শ্রেষ্ঠ ট্রেড ইউনিয়ন নেতার পুরস্কার। কোন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কারখানায় কতগুলি সফল ধর্মঘট করাইতে পারিয়াছেন, কতগুলি শিল্পে তালা ঝুলাইয়া লালবাতি জ্বালাইতে পারিয়াছেন, সিটু নেতাদের মধ্যে তাহার একটা রীতিমত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যাইতেই পারে। প্রতিযোগীদের মধ্য হইতে সর্বাপেক্ষা কৃতবিদ্য কাহাকেও বাছিয়া লওয়া খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। তাঁহার গলায় অতঃপর জ্যোতিবাবুর নামাঙ্কিত শ্রেষ্ঠ ট্রেড ইউনিয়ন নেতার স্বর্ণপদকটি ঝুলাইয়া দিলেই হইল। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মরা গাঙেও তাহাতে জোয়ার আসিল, আর মহান বামপন্থী নেতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ষোলোকলাও পূর্ণ হইল।’
ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে একদিকে যেমন কমরেড জ্যোতি বসু সম্পর্কে রুচিহীন মন্তব্য করা হয়েছে, তেমনই শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি, শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি কী অপরিসীম ঘৃণাবোধ কাজ করছে তারও প্রমাণ এই সম্পাদকীয়। কমরেড জ্যোতি বসু শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন বলেই তিনি জ্যোতি বসু, সেই দায়বদ্ধতা তাঁকে সারা জীবন শ্রমিক শ্রেণীর পাশে দাঁড় করিয়েছে বলেই শ্রমজীবী জনতার তিনি নয়নমণি ছিলেন। জ্যোতি বসুর এই উত্তরাধিকার বহন করাই কাজ, তাঁর জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলিই শ্রমজীবী আন্দোলনের সংগঠকদের ‘স্বর্ণপদক’ — কাঞ্চনমূল্যে পৃথিবীকে বোঝা আনন্দবাজারের মালিক ও তাঁদের স্তাবকদের এ কথা অনুভব করার মতোই বোধ নেই। দর্শনের পার্থক্য, দর্শনের দ্বন্দ্ব।
আনন্দবাজার লিখেছে: ‘একই ভাবে শ্রেষ্ঠ কৃষক সভা, শ্রেষ্ঠ পঞ্চায়েত ইত্যাদিকেও জ্যোতিবাবুর নামে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা যায়।’ এখানেও স্পষ্ট কীভাবে কৃষক সমাজ এমনকি গ্রামের মানুষের হাতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রতি আনন্দবাজারের কী তীব্র বিরোধিতা। এসব যে আরো একবার প্রকাশিত হয়েছে, তা ভালোই। এইসব শ্রেণী অবস্থান আনন্দবাজারের জন্মদাগ, বস্তুত এই শ্রেণী দর্শনের গর্ভেই আনন্দবাজারের জন্ম। কিন্তু ইদানীং মিডিয়া-বাণিজ্যের বড় মাতব্বরদের মুনাফা যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিজেদের ‘সর্বশক্তিমান’ ভাবার প্রবণতা। সেইমতো নিজেদের সুরার আসরের রুচিকে খবরের কাগজের পাতায় বা চ্যানেলের পর্দায় দেখানোর বহরও বাড়ছে। আনন্দবাজারের গত কয়েকদিনের বাঁদরনাচ এই ক্রমবর্ধমান রুচিবিকৃতির প্রমাণ।
তবে, মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে ৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের মালিকরাও বছরে একটি পুরস্কার দিয়ে থাকেন। এতদিন সাহিত্যের জন্য ওই পুরস্কার দেওয়া হতো। মনে হওয়া অসম্ভব নয় এবার থেকে সবচেয়ে ভালো খেউড় বলতে পারার জন্য ওই পুরস্কার দেওয়া হবে। বোঝাই যাচ্ছে, স্বয়ং মালিক-সম্পাদকই সবচেয়ে যোগ্য বিচারক হবেন।
আরো একটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায়: এমনকি বিপুল পুঁজির পাহাড়ও কোনো মানুষকে অবিনশ্বর রাখে না। কমরেড জ্যোতি বসুকে একবার চোখের দেখা দেখতে মানবকল্লোল আছড়ে পড়েছিল। আবার, অনেকের ক্ষেত্রেই সমব্যথী সারমেয়কুল ছাড়া কেউ শ্মশানবন্ধু হবে না!